মডেল মসজিদ: পিএসসির মাধ্যমে ইমাম নিয়োগ চাই!

img

সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনগণের টাকা ভালো কাজে ব্যবহার হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা অনেকে ভালোকে ভালো বলতে পারি না। যখন বিরোধিতা করি, বিরোধিতাই করি; পক্ষে বললে পক্ষেই। এ ভালো কাজের প্রশংসা করলে সরকারবিরোধীরা রাগ করছেন আবার এ কাজে কিছু ভুলত্রুটি থাকলে তা বললে সরকারপন্থীরা রাগ করছেন। কারো পক্ষে বললে একচেটিয়াভাবে বলতে হবে। আজ একজনের একটি ভালো কাজের প্রশংসা করলেন, আগামীকাল যদি তার একটি মন্দ কাজের সমালোচনা করেন সে নাখোশ হবে। চিরদিন আপনি যদি শুধু প্রশংসা করে যান, তাহেলই সে খুশি। আজও একজন আমাকে বললেন, এ নাকি সৌদি অর্থায়নে করা হয়েছে। এ কথাটি ঠিক নয়। বাংলাদেশের মানুষের টাকায়ই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এতবড় একটি কাজ সাহসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী করেছেন এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।

তবে প্রাথমিকভাবে মডেল মসজিদের ইমামদের বেতনস্কেল নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছেন। আসলেই ইমামদের বেতনস্কেলে এদেশের মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি। বিশেষ করে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এবং ইফা ডিজি বলেছিলেন, সরকারি স্কেলে ইমামদের বেতন দেওয়া হবে। মডেল মসজিদের খতিবদের জাতীয় বেতন স্কেলের অষ্টম গ্রেডে, ইমামদের নবম গ্রেডে, মোয়াজ্জিনদের ১৪তম গ্রেডে ও খাদেমদের ১৬তম গ্রেডে বেতনভাতা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মাদ আফজাল। ( ইত্তেফাক: ০৪ নভেম্বর, ২০) । দুঃখজনক হলো, ৫০টি মসজিদের উদ্বোধন করা হয়ছে, তাতে এর প্রতিফলন হয়নি। কোনোরকমের স্কেল ছাড়াই ১৫ হাজার টাকা বেতন ধরা হয়েছে। যা অন্যন্য অনেক মসজিদের বেতনের চেয়েও কম। বিশেষত রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ ইমামরা এর চেয়ে বেশি বেতন পান। মডেল মসজিদের স্টাফদের বেতনেও মডেল হবে তা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। মডেল মসজিদের ইমামদের রাষ্ট্রীয় কিছু দায়িত্বও পালন করতে হবে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে পাশের চেয়ারগুলোতে যারা বসবেন, তারা সবাই বেতন পাবেন লাখ টাকা আর ইমাম ১৫ হাজার। রাষ্ট্র যদি ইমামদের পেছনে টাকা খরচ করে তা কি দোষের কিছু? প্রশাসনের ভয়ে মানুষ অপরাধ ছাড়ে যতটা তার চেয়ে বেশি অপরাধ ছাড়ে ইমামদের বক্তব্যে। আমার কয়েক মুসল্লি জুমার খুতবা শুনে যৌতুকের টাকা ফেরত দিয়েছেন। ইমামদের পেছনে রাষ্ট্রের একটু ভালো বরাদ্দ থাকলে তা কখনোই ক্ষতির কারণ হবে না।

ইমামদের বেতন-ভাতা ও মসজিদ পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান কর্তাদের তা মনে আছে কি-না তা আমার জানা নেই। আমার মনে হয় তারা তা জানেন না। ১৭ অক্টোবর, ২০০৬ প্রকাশিত, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভেটকৃত সে নীতিমালার গেজেটে সিনিয়র পেশ ইমামদের ৫ম গ্রেড, পেশ ইমামের ৬ষ্ঠ গ্রেড, ইমামের ৯ম গ্রেড, প্রধান মুয়াজ্জিনের ১০ম গ্রেড এবং... প্রদানের নীতিমালা পাস হয়ে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত রয়েছে। সে অনুযায়ী বর্তমান স্কেলে ইমামমের ন্যূনতম বেতন হওয়ার কথা ২২ হাজার টাকা (সরকারি কলেজের প্রভাষকের বেতনের সমান)। দুঃখজনক হলো, মডেল মসজিদের ইমামের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিজের নীতিমালাই নিজে মানল না। সরকারের নীতিমালা থাকার পরও সরকারি কলেজগুলো ইমামদের বেতনের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা মানে না। মানে না সরকারি আলিয়া মাদ্রাসাগুলো। মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, সরকারি অফিসগুলো। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা কার্যকর রয়েছে। রাজধানী ঢাকার অনেক মসজিদ ইমামদের প্রথম শ্রেণির স্কেল দিয়ে নীতিমালা করছে।

তবে আমরা একদম আশাহত নই, মডেল মসজিদ পরিচালনা নীতিমালায় স্থায়ী জনবল কাঠামো প্রণয়ন করা হবে বলে বলা হয়েছে। সে জনবল কাঠামোতে ২০০৬ সালের সে নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইমামদের প্রবেশনারি বেতন ৯ম গ্রেডে পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির মাধ্যমে ৫ম গ্রেডে উন্নীত, খতিবদের ৮ম গ্রেড থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে ৪র্থ গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখা হবে বলে আমরা আশা করি। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। মডেল মসজিদ যদি অন্যান্য মসজিদের চেয়ে সম্মানজনক বেতন না হয় তাহলে তো যোগ্যরা এতে আসবে না। নির্মাণের দিক থেকে মডেল হলেও বাস্তবে তা মডেল মসজিদ হবে না।
নিয়োগ উপজেলা পর্যায়ের একজন ইমামের প্রথম শ্রেণির বেতনকাঠামো যেমন প্রত্যাশা করছি, তেমনি ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণের কাজ করার মতো যোগ্য ইমাম নিয়োগের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়াও সচ্ছ হোক তা প্রত্যাশা করছি।

উপজেলা পর্যায়ের একজন মডেল ইমামকে হতে হবে শতভাগ শুদ্ধ তিলাওয়াতের অধিকারী। শুদ্ধ বাংলা বলা ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় পারদর্শী। জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখায়ও ন্যূনতম পদচারণা থাকবে। এ মানের ইমাম পেতে প্রয়োজনে পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা এ ধরণের কোনো সংস্থার মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যেমে নিয়োগ দেওয়া হোক! ৫৬০টি মডেল মসজিদ ৫৬০টি সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় রয়েছে। যা অনেক বড় ব্যাপার। সরকারি কামিল মাদরাসাগুলোর আরবি ও তাফসির বিষয়ক প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএসের মাধ্যমে। ইমাম নিয়োগের জন্য দাওরায়ে হাদিস/কামিলকে বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি বা ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স মাস্টার্স (অবশ্যই ক্বিরাত শুদ্ধ হতে হবে) মৌলিক যেগ্যতা রেখে বিসিএসের আদলে তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আরবি, ইলমুল ক্বিরাত এ বিষয়গুলোতে ২৫ করে ১২৫ এবং বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞানে ১০ করে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বাকি ৪৫ নাম্বারে মৌখিক হিফজুল কোরআন ও ক্বিরাতে মৌখিক পরীক্ষা (১০+১০) ২০ এবংবাকি অন্যান্য বিষয়ে ২৫ নাম্বারের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বিসিএস ক্যাডারের সমমান দিয়ে ইমাম নিয়োগ দিলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। ভাইভার জন্য অবশ্যই কওমি ও আলিয়া ধারার ২ জন করে আলেম ও ইসলামিক স্টাডিজ/আরবি বিষয়ের ১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাখতে হবে। এতে যে সরকারের অনেক বেশি টাকা খরচ হবে তা নয়। স্বাভাবিক খরচের সঙ্গে বছরে মাত্র ১৩০ কোটি টাকা যুক্ত করলেই হবে। মসজিদ নির্মাণে সরকারের খরচ ৯ হাজার কোটি টাকা। এ ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ দেশ ও জাতির কল্যাণে অধিকতর কাজে লাগবে যদি নিয়োগ প্রক্রিয়া মানসম্মত করা হয়। আশা করি চূড়ান্ত জনবল কাঠামো তৈরিতে সরকার এ বিষয়ে খেয়াল রাখবে।