লেখালেখি একটি বিশেষ গুণ। এটা আল্লাহ তাআলা কাউকে কাউকে বিশেষভাবে দান করেন। সবাই লেখক হতে পারে না। কিছুটা স্রষ্টা প্রদত্ত এ গুণ সবার মধ্যে দেখা যায় না। যিনি সত্যিকার অর্থেই লেখক, সংগঠন দিয়ে তার কোনো পরিচয় হতে পারে না। কোনো সংগঠন কোনো জাত লেখককে ধারণ করতে সক্ষম না। একজন লেখকের সাথে সংগঠন মানানসই না। তারপরও সংগঠন গড়ে ওঠে। সংগঠন গড়তে হয়। বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম প্রতিষ্ঠার যখন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যখন একের পর এক মিটিং করা হয়, তখনও এ নিয়ে অনেক কথা আশ-পাশ থেকে শোনা গিয়েছে। আজকের ইসলামী লেখক ফোরামে যারা দায়িত্বে আছে, সেদিন সেই স্বপ্নের সাথে তাদের কেউ জড়িত ছিলেন না। লেখক ফোরাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের সাথে মূল স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম ছিলাম আমি, জহির উদ্দীন বাবর, মুফতি এনায়েতুল্লাহ ও গাজী সানাউল্লাহ ভাই। এই চার জনই ছিলাম মূল চিন্তার সারথী। এছাড়াও যারা ছিলেন তাদের অন্যতম হলেন লাবিব আব্দুল্লাহ ভাই, হুমায়ুন আইয়ুব, আলী হাসান তৈয়ব, আব্দুল গাফফার প্রমুখ। লেখক ফোরামের গঠনতন্ত্রের ৯৫% লেখা আমার। প্রতিটি শব্দে ছিল আমার স্বপ্নের ছোঁয়া। ৫% হয়তো নানা মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন করা হয়েছে। লেখকদের নিয়ে ২০১২সালের সেই সব তৎপরতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের অনেকে এখন লেখক ফোরামের অন্যতম আলোচক, সংগঠক, পৃষ্টপোষক। সেদিনও যা বলেছিলাম এখনো তাই বলবো। সংগঠন কাউকে লেখক বানায় না। আবার জাত লেখকদেরও কোনো সংগঠন হয় না। কোনো জাত লেখক সংগঠনের আওতায় থাকা পছন্দ করবেন না। তারপরও সংগঠন গড়ে উঠে, সংগঠন তৈরি হয়। কিন্তু কেন?
খুব বেশি মেধাবীরা সংগঠন করতে পারেন না। সংগঠন এক ধরনের ধীর গতির নানাবিধ পিচ্ছিল প্রক্রিয়া। মেধাবীরা এসব পিছুটানের পিছনে কখনোই ছুটে না। কিন্তু মেধাবীদের ধারণ করার জন্য সংগঠনের দরকার আছে। সংগঠন মেধাবীদের যখন মূল্যায়ন করতে শেখে তখন মেধাবীদের এই সুনামে সংগঠনের ব্যানারে যারা কাজ করে তারাও কিছুটা ভাগ বসায়। সংগঠনে মেধাবীরাই জ্যোতি ছড়ায়। মেধাবীরা যদি সংগঠনের দিকে একটু নজর দেয়, তাহলে সেই সংগঠন হয়ে উঠে অনন্য। মানুষ যেমন সমাজ ছাড়া বাস করতে পারে না, তেমনি মেধাবী লেখকরা সংগঠন ছাড়া অনন্য উচ্চতায় যেতে পারেন না। তাদের খ্যাতি-জ্যোতিকে চারিদিকে বিনাস্বার্থে ছড়িয়ে দেয় সংগঠন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন কোনো লেখক সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতেন সেটা হয়ে উঠতো গোটা জাতির কাছে স্মৃতিময়। চারিদিকে জাতীয় কবির সৌরভকে ছড়িয়ে দিতো সেই সময়ের নানা লেখক সংগঠন। সারা দুনিয়ায় অসংখ্য বুদ্ধিজীবি ও লেখক সংগঠন আছে। এর প্রতিষ্ঠাতারা সকলেই যে খুব বড় জ্ঞানী-গুণী, তা না। কিন্তু সারা দুনিয়ার বড় বড় লেখকদেরকে গণ মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে এসব সংগঠনের জুড়ি নেই।
সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সারা দুনিয়ার যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার লেখক সংগঠনগুলো তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতাহুল পৃথিবীর যেসকল প্রান্তে যান, সেখানের লেখক সংগঠনগুলোই তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান জানায়। একজন তাকী উসমানী হাজারো সংগঠন দিয়েও বানানো যাবে না, কিন্তু সংগঠন ছাড়া আবার একজন তাকী উসমানীও কেউ হয়ে উঠতে পারবেন না। কত মেধাবী লেখক নীরবে লেখে হারিয়ে গেছেন। সংগঠন সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে তাদের আজ কেউ চিনে না। তাদের কিতাব কেউ ছুঁয়েও দেখে না। রাবেতাতু আদাবুল আরবী আর আলমী আল্লামা নদভী রহ.কে বিশ্বময় পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বিশ্বমানের লেখক সংগঠন না থাকার কারণে এদেশের লেখকরা সমগ্র বিশ্বে পরিচিত না। অনেক জনপ্রিয় বড় আলেম আছে। কিন্তু দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের কোনো আলেম তাকী উসমানী হয়ে উঠতে পারেননি। এর বড় কারণ, দেশে লেখকদেরকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করার উদ্যোগ নিতে সক্ষম এমন লেখক সংগঠন তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সেই চিন্তা থেকেই লেখক সংগঠন করা হয়েছিল। লেখক ফোরামের গঠনতন্ত্র পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন, কী আশা নিয়ে সেদিন লেখক সংগঠন করা হয়েছিল। আমরা সাফল্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছি বাঙ্গালীর কিছূ অসাধারণ বদগুণের কারণে। পেছন থেকে টেনে ধরা আমাদের জাতীয় হা-ডু-ডু খেলার শিক্ষা আমাদেরকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে দেয়নি সত্য। তবে, আমরা একেবারে ব্যর্থ নই। লেখক ফোরাম বলেন আর জাতীয় লেখক পরিষদ বলেন, এসব সংগঠন সামান্য হলেও লেখকদের সংগঠিত করতে, লেখকদেরকে সম্মানিত করতেই কাজ করছে। হয়তো পরিধিটা খুব বড় করতে পারেনি। কিন্তু আন্তরিকভাবে যদি এদেশের লেখকরা এসব ছোট-খাটো সংগঠনগুলোকে মূল্যায়ন করতেন, তাহলে উপকার হতো লেখকদেরই।
অনেকেই এসব সংগঠনের তুমুল সমালোচনা করেন। লেখক সংগঠনগুলো জাতিকে কী উপহার দিয়েছে? কয়জন লেখক বানিয়েছে? অযোগ্যরাই সংগঠনের বড় বড় পদ দখল করে আছে? আচ্ছা, আপনাকে প্রশ্ন করি, মনে করেন আমাদের প্রিয় লেখক মুসা আল হাফিজ। যে কোনো লেখক সংগঠনের উনি সভাপতি হওয়াটাই যুক্তিসংগত। কিন্তু উনি যদি কোনো লেখক সংগঠনের সভাপতি হয়, অথবা সেক্রেটারী হয়, তাহলে তখন আর তিনি মুসা আল হাফিজ থাকতে পারবেন না। সংগঠন করতে গেলে কত দুর্বলকে তেল মারতে হয়, কত সবলের পায়ে ধরতে হয় তারপরেই সংগঠন টিকে। সীমাহীন ছাড় দিতে হয়। তাহলেই সংগঠন দাঁড়ায়। কিন্তু একজন মুসা আল হাফিজ লিখবেন নাকি তেল মারবেন? এখানে উদাহরণত: মুসা আল হাফিজ ভাইয়ের নাম বললাম। আমাদের যদি জাতীয় মানের সমৃদ্ধ লেখক সংগঠন থাকতো, তাহলে আমরা একজন মুসা আল হাফিজকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলতে পারতাম।
শক্তিশালী লেখক সংগঠন দেশের লেখকদের স্বার্থেই প্রয়োজন। কাজের সুবিধার্থে একাধিক সংগঠন থাকা দোষের নয়। কাজ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সকলেরই উচিত কাজ চালিয়ে যাওয়া। যে ভালো করবে সে টিকবে। যে ভালো করতে পারবে না, সে টিকবে না। হারিয়ে যাবে। কাজের প্রতিযোগিতা থাকবে। একসময় বাংলাদেশে সাইমুম নামে মাত্র একটি শিল্পী গোষ্ঠীর নামই শুনতাম। এখন অসংখ্য। এর সুফলও এদেশবাসী পেয়েছে। ইসলামী সংগীতের ময়দানে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। অসংখ্য লেখক সংগঠন থাকলে কোনো একটি সংগঠন যদি বিশ্বমানের হয়ে র্দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের লেখকরা একসময় এসব সংগঠনের সহযোগিতায় বিশ্বমঞ্চও কাঁপাবে।
আসুন. পরস্পরে সহযোগিতা করি। কাজের মূল্যায়ণ করি। প্রশংসা করি। কোনো উপকার করতে না পারি, তাহলে চুপ থাকি। যারা সংগঠন করে, একমাত্র তারাই জানে কতটা ত্যাগ, শ্রম, আর ঘামের বিনিময়ে ছোট থেকে ছোট্ট একটি সংগঠন দাঁড়ায়। আপনার অহেতুক উপহাস অনেকের হৃদয় ভেঙ্গে দেয়। কী দরকার আপনার প্রসঙ্গ না থাকলে অহেতুক খোঁচা মারার? যে কোনো সংগঠনের কাজ নিয়ে পর্যালোচনা হতে পারে। তাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বিশ্বমানের বড় লেখক হতে হলে বিশ্বমানের বড় কোনো লেখক সংগঠনও লাগবে। কথাটা অনেকের হয়তো বুঝে আসবে না, অনেকে হয়তো একমত হবেন না।
07.01.2023
সদস্য : জাতীয় লেখক পরিষদ