বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাতার বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে উত্তাপ। প্রিয় দলের পতাকায় ছেয়ে গেছে দেশের আকাশ। ৯২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মুসলিম দেশে বিশ্বকাপের মতো এত বড় আয়োজন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নানা কারণেই এটা নিয়ে ইসলামপন্থিদের মধ্যেও চলছে নানামুখী পর্যালোচনা। সোশ্যাল মিডিয়ার আইডিগুলো এসব বিষয়ে পর্যালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এটাকে খুব নেতিবাচকভাবেও দেখছেন। তাদের কারও কথায় মনে হয়, কাতারের আমির বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বে ইসলামি খেলাফত কায়েমের ডাক ফেলেছেন; আবার কারও কথায় মনে হয়, এটা করে কাতার মুসলিমবিশ্ব থেকেই খারিজ হয়ে যাচ্ছে। আসলেই কি বিষয়টি এমন? একটি খেলাকে কেন্দ্র করে এভাবে কি আমাদের চিন্তা করা উচিত? আমরা এমন একটি ব্যয়বহুল আয়োজনকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি? অতীতের যতগুলো বিশ্বকাপ আয়োজন হয়েছে, তার অনেকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে এই খেলার আয়োজনে। একটি মরুভূমির দেশে এমন বিশ্ব-আসরের আয়োজন সম্ভব কি-না, সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রায় ২২৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করে সম্পূর্ণরূপে নতুন ৮টি স্টেডিয়ামসহ সেই পরিমাণ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন নতুন হোটেল তৈরি করা হয়েছে।
বাস্তবতার আড়ালে অন্য গল্প
একটি মুসলিম দেশের পক্ষে এতটা ব্যয়বহুল খেলার আয়োজন কি যথার্থ হচ্ছে? এ প্রশ্ন আসতেই পারে। একটি মুসলিম দেশের পক্ষে এমন আয়োজনের যে ভিন্নরকম বার্তা রয়েছে বিশ্ববাসীর জন্য, সেটাও অনায়াসে বলা যায়। তবে এটাকে আর দশটা বিশ্বকাপের মতোই একটা খেলার আয়োজন মনে করাটাই অধিকতর যুক্তিসংগত হবে। এর বাইরে ধর্মতাত্ত্বিকভাবে এটা নিয়ে পর্যালোচনা করলে অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আসবে। খেলাটাকে শুধুই খেলা হিসেবে দেখা উচিত। এর পাশাপাশি একটি অন্য প্রসঙ্গ আসতে পারে। তা হলো, এত বড় একটি আয়োজনের দ্বারা কি শুধু খেলায় জয়-পরাজয় দেখাটাই অর্জন নাকি অন্য কোনো অর্জন এর দ্বারা সম্ভব? আসলে এর দ্বারা খেলার বাইরেও একটা বড় অর্জন আছে, যা এ মুহূর্তে কোনো মুসলিম দেশের জন্য প্রয়োজন ছিল। তা হলো, গোটা বিশ্বে এর একটি সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়বে অজান্তেই। আর কাতারের মতো একটি দক্ষ দেশের হাতে বিশ্বকাপের মতো আসর আয়োজনের দায়িত্ব পড়ায় তারা খুব ভালোভাবেই সেই বার্তাটি বিশ্ববাসীকে দিতে পারবে, এরই মধ্যে এর প্রমাণ মিলছে। আমাদের দেশের কিছু লোক অবশ্য যেভাবে কাতারকে তুলাধুনা করছেন, তা না করে যদি কাতারের এই বিশ্ব আয়োজন দ্বারা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সুদূরপ্রসারী কী প্রভাব গোটা বিশ্বে পড়বে, সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন, তাহলে হয়তো ভালো হতো। কাতারের আমির বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিশ্ববরেণ্য দাঈ ডা. জাকির নায়েককে খেলার এ মুহূর্তে কাতারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এটা নিয়েও কারও কারও মধ্যে যদিও অস্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার অন্য একটি পক্ষ পুরোনো নানা কিছু খবর রটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করছেন। এতজন ইসলাম গ্রহণ করেছে, বিশ্বকাপের আগেই এতজন মুসলিম, মাশাআল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! এসব খবরে ফেইসবুকের ওয়াল ভরে যাচ্ছে। খেলাকে কেন্দ্র করে এসব বিষয় ভালোই উপভোগ করছেন দেশের ফেইসবুকাররা। আসলে খেলা নিয়ে এত মাতামাতিরও যেমন কিছু নেই, আবার এটা নিয়ে একটি মুসলিম দেশকে তুলাধুনা করারও কিছু নেই।
সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের আসল রহস্য
প্রাসঙ্গিক কারণে দু-একটি কথা বলতেই হয়। দুনিয়ার অনেক দেশের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে। সেটার মালিক হয় কোনো দেশ হিন্দু, কোনো দেশ ইহুদি, কোনো দেশ বৌদ্ধ, কোনো দেশ খ্রিস্টান। কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্রকেই সে দেশের ধর্ম দিয়ে আখ্যায়িত করা হয় না। ব্যতিক্রম একমাত্র পাকিস্তান। মুসলিম দেশের কাছে কেন পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে? অতএব, এর নাম হলো ‘ইসলামি বোমা’। ইসরাইলেরটা ইহুদি বোমা নয়, চীনেরটা বৌদ্ধ বোমা নয়, ভারতেরটা হিন্দু বোমা নয়, আমেরিকারটা খ্রিস্টান বোমা নয়। কিন্তু পাকিন্তানেরটা ‘ইসলামি বোমা’। এমনই একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে কাতার বিশ্বকাপকে সামনে রেখে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, এটা হলো ইসলামি বিশ্বকাপ। বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশে এই খেলার আসর বসেছে। সেগুলো নিয়ে ধর্মীয় কোনো মাতামাতি হয়নি। প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্বকাপ উপলক্ষে তুলে ধরেছে। এ নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু কাতার যখনই তার নিজ খরচে, নিজ দেশে খেলার আয়োজন করতে গিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের লালিত নানা সংস্কৃতি তুলে ধরতে চাইছে, তখন সেটাই হয়ে যাচ্ছে ‘ইসলামি বিশ্বকাপ’। কিছু অবুঝ মুসলিমও এটা নিয়ে ট্রলবাজি করছে।
মনে রাখতে হবে, আমরা কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে যতই ট্রলবাজি করি না কেন, এর একটা সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আছে। কাতার বিনা কারণেই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে বলে মনে হয় না। কাতারের একের পর এক কঠিন সিদ্ধান্ত গোটা দুনিয়ার ক্রীড়ামোদীদের আপত্তি সত্ত্বেও মেনে নিতে হচ্ছে। বিশ্বকাপ হবে আর আকামের ছড়াছড়ি হবে না, মদণ্ডগাঁজা আর নারীবাদীদের উলঙ্গ মাতামাতি হবে না, তা কি কোনোদিন কল্পনা করা গেছে? আজ সেটাই করে দেখাচ্ছে কাতার। এই খেলাটা অন্য কোনো আরব দেশে হলে সেটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে যেত। পশ্চিমাদের খুশি করতে গিয়ে ইসলামকে তাদের পদতলে সঁপে দিত। কিন্তু কাতার ছোট্ট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি সিদ্ধান্তে সে কঠোর ও অনঢ়। খেলার আসরে মদ চলবে না, জানিয়ে দিল একেবারে খেলার অন্তিম মুহূর্তে, নারীদের শরীর যতদূর সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। খোলামেলা পোশাক চলবে না। সমকামিতা চলবে না। এটা গোটা ইউরোপের পাগলা সমর্থকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে।
কাতারের সমালোচনায় ইউরোপ ও তার জবাব
ইউরোপ কাতারের সমালোচনায় মাঠে নেমে আসে। তারা কাতার নিয়ে নানা ব্যঙ্গ করছে। কিন্তু কাতার চুল পরিমাণও ছাড় দেয়নি। উপরন্তু ফিফা সভাপতির মুখ দিয়ে যে কথাটি বেরিয়েছে, তা হাজার কোটি টাকা খরচ করেও হয়তো বা বের করা যেত না। কাতারের অসাধারণ আয়োজন, সামর্থ্যরে প্রমাণ প্রদর্শন ইত্যাদিতে মুগ্ধ হয়ে ফিফা সভাপতি গোটা ইউরোপকে যে বার্তা দিয়েছেন, তা এক কথায় অসাধারণ। তিনি তাদের সমালোচনার জবাবে বলেছেন, ‘ইউরোপ অতীতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যে অসভ্য আচরণ করেছে, গত ৩ হাজার বছর ধরে যা করেছে, তার জন্য আগামী ৩ হাজার বছর তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
কাতার বিশ্বকাপ গোটা ইউরোপ ও পশ্চিমা শক্তিকে একটি সাংস্কৃতিক বার্তা দিতে সক্ষম হবে। দর্শকদের কাছে ইসলামকে আধুনিক যুগের উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে সমুন্নত করতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়ে কোনো মুসলমান তিরস্কার করতে পারে না। কাতার বিশ্বকাপে এগুলো না করে ‘মেয়েবাজি আর মদ’ নিয়ে মাতামাতির আসর জমালেও আমাদের কিছু করার ছিল না। কিন্তু কাতার সেটা করেনি। তারা মেরুদণ্ড সোজা রেখেছে। এ জন্য কাতারকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। গোটা পাশ্চাত্য শক্তির কাছে একটি ছোট্ট দেশ কাতার তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে যে আলোর ছটা ছিটিয়েছে, তা এক কথায় অসাধারণ। সারা দুনিয়ার মানুষ মুসলমানদের সবসময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। মুসলিম দেশগুলোকে ফকির-মিসকিনের দেশ বলত। আজ তারা যখন দেখছে, একটি ছোট্ট মুসলিম দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক সামর্থ্য কতটা উন্নত, তখন তারা অজান্তেই অনেক কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হবে। অজান্তেই তারা ইসলামি সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতির কাছে হার মানবে। তাদের সভ্যতা যে মিথ্যা, ভুয়া ও অনৈতিকতায় ভরা, তা আবারও প্রমাণিত হবে।
কাতারের জন্য শুভ কামনা
সর্বোপরি, সারা দুনিয়ার চোখ এখন কাতারের দিকে। কাতার কী করছে, খেলায় তারা কী ব্যতিক্রম আয়োজন করেছে, কীভাবে এত বড় একটি আয়োজনকে সম্ভব করেছে, তা নিয়ে ভাববে। অতএব, খেলাকে খেলার দৃষ্টিতেই দেখা উচিত। এখানের প্রতিটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কাতার এই খেলা আয়োজন করে মুসলমানদের ক্ষতি করেছে না-কি ভালো করেছে, এর মূল্যায়ন করা যাবে। কাতারের এই আয়োজনে মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে না-কি ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে, তাও দেখা যাবে। তবে কাতার এরই মধ্যে নিজেকে সক্ষম ও সামর্থ্যবান বিশ্ব খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেছে। এটা ছোট্ট একটি মুসলিম দেশের পক্ষে কম অর্জন নয়। কাতারের এ বিশ্ব আয়োজন পুরোটাই পাশ্চাত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাতারের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে একটি সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বিজয়ের পূর্ব মহড়া। গোটা পাশ্চাত্য শক্তির সামনে ইসলামি সভ্যতার দাওয়াত পৌঁছে যাবে তাদের অজান্তেই। তাদের প্রতিটি চোখ এখন একটি মুসলিম দেশের দিকে। তারা দেখছে। অনুভব করছে। দক্ষতার সঙ্গে এই আয়োজন সম্পন্ন করতে পারলে মনে করি, সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানদের গর্ব করার জায়গা তৈরি হবে। যদিও এটা কোনো দাওয়াতি আসর নয়, তবু কাতার যেন অজান্তেই বিশ্বকাপকে দাওয়াতের ময়দানও বানিয়ে ছেড়েছে।
লেখক : সিনিয়র সহসভাপতি, জাতীয়
লেখক পরিষদ