ইরানের সাথে ধর্মীয় সেতুবন্ধন সুফল বয়ে আনবে না

img

ইরান মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিশালি দেশ। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সমরাস্ত্রের আধুনিকায়নের মাধ্যমে তারা নানা দিক দিয়ে একটি অবস্থান তৈরি নিয়েছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইরান আলোচনায় আসে। কিছুদিন যাবত বাংলাদেশে ইরানি স্কলারদের আনাগোনা বেড়েছে। এই নিয়ে বিশ্লেষণ বাড়ছে। শিয়াইজম থেকে শুরু করে অতীত প্রসঙ্গ টেনে লেখালেখি হচ্ছে। আমি ঐ দিকে যাবো না। সেটা বড় স্কলারগণ করবেন। আমি ইরানের সাথে ধর্মীয় সেতু বন্ধন এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক কী প্রভাব পড়তে পারে সেই দিকটা একটু আলোচনা করবো।

বাংলাদেশের ধর্মীয় অনুভূতি, রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, ইরানের সাথে আমাদের ধর্মীয় সম্পর্ক স্বাভাবিকিকরণের দ্বারা বাংলাদেশের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কীভাবে ক্ষতির সম্ভাবনা সে দিকটি নিয়েই আজ আলোচনা করবো।

রাজনৈতিক :
ইরানের সাথে আমাদের ধর্মীয় সখ্যতা বাড়ালে আমরা রাজনৈতিকভাবেও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবো। কেননা ইরানের সাথে রাশিয়া এবং ভারতের ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশি এবং একমাত্র শত্রুরাষ্ট্র, যাদের পক্ষ থেকে আমাদের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কোনো কারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সংঘাতমূলক পরিস্থিতি তৈরি হলে ইরান কোনোভাবেই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে না। ইরানের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্টতা ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইরান আফগানিস্তানে নোংরা রাজনীতির চর্চা করেছে। জেনারেল সোলাইমান কাসেমী মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংসের মূল কারিগর ছিলেন। সুন্নী মুসলমানদের ব্যাপারে ইরানে ভয়ঙ্কর মানসিকতা সম্পর্কে জানতে হলে এসব দেশের মুসলমানদের সাথে সামান্য কথা বললেই বুঝা যাবে। সুতরাং ইরানের সাথে বাংলাদেশের মুসলমানদের ঘনিষ্টতা নতুন করে বিপদের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ প্রায় শতভাগ একটি সুন্নী প্রধান রাষ্ট্র। এখানে ইরানের হাত না থাকায় শিয়া সুন্নী সংঘাতের কোনো খবর পাওয়া যায় না। যদিও এদেশে অতীত কালের চর্চা থেকে ইরানী অনেক সংস্কৃতি চর্চা অসচেতনভাবে হয়ে থাকে।

অর্থনৈতিক :
ইরানের সাথে বাংলাদেশের মুসলমানদের নতুন করে ঘনিষ্টতা বাড়ালে তাতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তেমন কোনো ফায়দা নেই। ইরান অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বি দেশ নয়। তারা যথেষ্ট দারিদ্র মোকাবেলা করেই টিকে আছে। এখানের নতুন প্রজন্ম ফারসি ভাষা শিখে ইরানে গিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারবে না। ইরান একটি আদর্শিক শক্তিশালি রাষ্ট্র। যেই আদর্শের সাথে বাংলাদেশের মুসলমানদের কোনো মিল নেই। দেশের সরকারের সাথে তাদের ঘনিষ্টতা তৈরি হতে পারে, তাহলে তাতে কিছুটা সুবিধা লাভ করতে পারে। কমমুল্যে তেল সংগ্রহ করতে পারে। গ্যাস সংগ্রহ করতে পারে। সেটা সরকারি পর্যায়ে হলে আদর্শিক সংঘাত তৈরির সম্ভাবনা কম। কিন্তু যেহেতু ইরান একটি মুসলিম দেশ এবং বাংলাদেশও একটি মুসলিম দেশ, তদুপরি ধর্মীয় দর্শনের সাথে ইরানের সাথে বাংলাদেশের আলেম-উলামা, সাধারণ দীনদার মানুষের দূরত্ব রয়েছে, সেই দূরত্ব হ্রাস করতে গেলে দেশের ভেতরে নতুন করে ধর্মীয় সংঘাত তৈরির সম্ভাবনা আছে। যেটা আমরা পাকিস্তানে প্রায়শই দেখি। আফগানে দেখি।

ধর্মীয় :
ইরানের সাথে সুন্নী মুসলমানদের ধর্মীয় সংঘাত হাজার বছরের। মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির মূলে রয়েছে ইরান। উসমানি খেলাফতের সময়ে চেঙ্গিস খান বাহিনীর সাথে মিলে সুন্নী মুসলমানদের ওপরে তার উপযুপরি আঘাতের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ধর্মীয় কারণে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে ইরান। যারা এসব বিষয় সম্পর্কে না জেনেই শুধুমাত্র ইরানের ইসলামী শ্লোগান দেখে আবেগাপ্লুত হন, তারা চরম ভুলের মধ্যে আছেন। আজকের ইরাক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে ইরানের কারণে। সিরিয়ার যে সকল প্রদেশে সুন্নি মুসলমান ছিল তাদেরকে কী পরিমাণ জুলুম করেছে ইরানের মিলিশিয়া বাহিনী তা ইতিহাসে কলঙ্কের দাগ তৈরি করেছে। হিমসসহ বিভিন্ন প্রদেশে ইরানের মিলিশিয়া বাহিনী বাশার বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার আড়ালে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে।

এছাড়া ইরানের ধর্মীয় নেতাদেরকে যতটা ধার্মিক মনে করা হয়, তারা ততটাই শঠ ও প্রতারক। এদের বাইরে একরূপ, ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। শিয়াইজম ইয়াহুদীবাদের খুব ঘনিষ্ট। ধর্মীয় প্রতারণাকে তারা বৈধ মনে করে। সারাজীবন একটি ইসলামী সংগীত হৃদয়ের গভীর থেকে শুনেছেন। সেটা হলো, ইমাম হোসাইন রা.কে যখন মদীনা থেকে কুফায় আসার আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল, যারা জানিয়েছিল, তাদের সকলেই ছিল আজকের শিয়াবাদের গুরুরা। তাদের মুনাফিকির কথাই আমরা দেখতে চাই নিম্নের কবিতায়। সেটা হলো :

মুজে কুফাওয়ালু, মুসাফির না সমঝো
মায় আয়া নিহি হো, বুলায়া গায়া হো
কবিতাটির সারমর্ম হলো, হে কুফাবাসি, তোমরা আমার সাথে এমন আচরণ করছো কেন, আমিতো স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি। আমাকে আসতে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে। আমাকের এই আমন্ত্রনের মাধ্যমে আমাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে। আমাকে যন্ত্রনা দেওয়া হয়েছে। এসব কথা তাদের উদ্দেশ্যেই বলা যারা আজকে হোসাইন রা. এর জন্য সবচেয়ে বেশি মায়াকান্না করে।

কুফা নগরীর মানুষদের রাজনৈতিক ভন্ডামির ইতিহাস হাজার বছরের। সাদ্দামের পতন পর্যন্তই তাদের গাদ্দারির ইতিহাস। সুতরাং এই রকম একটি ধর্মীয়ভাবে ভন্ড সম্প্রদায়ের সাথে সেতুবন্ধন বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনবে না।

তাদের ভাষা ফারসি। বাংলাদেশ থেকে ফারসি ভাষা চর্চা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এটাকে পুনরুজ্জীবিত করে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশের মুসলমানদের দরকার ব্যাপকভাবে আরবি ভাষা চর্চার। এর মাধ্যমে ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনেক উপকার রয়েছে।

সাংস্কৃতিক :
ইরানের যে সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করা হয়, তা থেকে বাংলাদেশের মুসলমানরা ধীরে ধীরে দূরে চলে এসেছে। তাদের সুফীইজম, তাদের শিয়াবাদ, ইসনা আশারিয়া মতবাদ, কারবালা কেন্দ্রিক তাদের মাতমবাদ এগুলো বাংলাদেশের মুসলমানরা আবার নতুন করে গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের হোসনি দালান কেন্দ্রিক যে আশুরার তৎপরতা কিছুটা দেখা যায়, তা মূলধারার সাথে এখন আর কেউ বিবেচনা করে না।

একটা সময় ছিল যখন ভারতবর্ষ এক ছিল। ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল। তখন রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ফারসির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এসব কারণে সাংস্কৃতিকভাবে ইরান এদেশের মুসলমানদের কাছাকাছি থাকলেও এখন সেই সখ্যতা নেই। ভাষাও নেই। সংস্কৃতিও নেই। সুতরাং নতুন করে বাংলাদেশে ফারসী চর্চার ঢেউ তুলে লাভ নেই। ইরান খুব সতর্কতার সাথে তার সংস্কৃতিকে আরব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তারা ফারসি ভাষাকে আগলে রেখেছে। সেখানে কোনোভাবেই আরব্য সংস্কৃতিকে তারা প্রবেশ করতে দেয়নি। আমাদের যদি নতুন করে সম্পর্কের গভীরতা তৈরি করতে হয়, তাহলে সেটা আরবদের সাথে করতে হবে। পারস্যের সাথে নয়।

পরিশেষে তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলতে চাই, যারা বাংলাদেশে ফারসী চর্চার নতুন জোয়ার দেখতে চান, যারা ইরানের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতা তৈরিতে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে চান, তারা নিজ নিজ জায়গায় সীমিত থাকুন। এদেশে ধর্মীয় অঙ্গনে যথেষ্ট স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এখানে নতুন করে ধর্মীয় সংঘাত তৈরিতে আগুনে ঘি ঢালবেন না। কেউ যদি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া মনে করেন, আপনি এদেশে ইরানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভাব বিস্তাবে ভূমিকা রাখবেন, তারা হয় আমাদেরকে ত্যাগ করুন, নতুবা আপনাদেরকে আমাদের ত্যাগ করতে হবে। আমরা নতুন করে ধমীয় সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করতে চাই না। এমনিতেই বাংলাদেশে ধর্মীয় অঙ্গনে ভেদাভেদ বাড়াতে নানামুখি চেষ্টা চলমান। কওমী, আলিয়া, সুন্নি, ওয়াহাবি, আহলে হাদীস এগুলোর বাড়াবাড়িতেই অতীষ্ট। শিয়াবাদকে আর দয়া করে সামনে আনবেন না।

বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট বিআইএম

22.08.2022