বাংলাদেশ ইসলামের জন্য একটি উর্বর ভূমি, এ কথাটি অসংখ্যবার শুনেছি। কিন্তু বারবার একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি যে, এদেশ মুসলমানদের হলেও ইসলাম সবসময়ই পরাজিত থেকেছে। এদেশে ইসলাম এখনো বিজয়ীর আসনে অধিষ্টিত হতে পারেনি। যে কারণে পরীমণি নামক একজন বিতর্কিত নারী, যার গোটা জীবনটাই উৎসৃঙ্খলায় ভরা, রাত-বিরাতে যে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন ক্লাব বা বারে, দেশের শীষস্থানীয় আমলা-কামলাদের নিয়ে রাত কাটায় দেশ-বিদেশে, তাকে নিয়ে আদালতপাড়া অস্থির হয়ে উঠে, আইনজীবিরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায় তাঁর অধিকার রক্ষার জন্য, অথচ শত শত আলেম জেলবন্দি, তাদের জামিন প্রসঙ্গে আদালতে কথাই বলা যায় না।
কোন পাহাড়ে কোন ছাত্র আজান দিয়ে এ কথা বলে, এদেশে একদিন ইসলামের পতাকা পতপত করে উড়বে, সেই অপরাধে তাদেরকে মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। ইসলামী শাসন, বিচার, সংস্কৃতির বিকাশতো দূরের কথা ন্যুনতম মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকায় যেন দায় এই দেশে, এই রাষ্ট্রে, এই সমাজে। অথচ এদেশে লাখ লাখ আলেম, হাফেজ, কারী, মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, দরবার, মুজাহিদ, রাসুল সেনা, কোন কিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু একটাই সেটা হলো, ইসলাম নানাভাবে নির্যাতিত এ নিয়ে কেউ সাহস করে কথা বলতে পারে না। কথা বলতে দেওয়া হয় না। কেউ একজন বললেও পাশের জন সমর্থন করে না। যে কোন কোন আওয়াজ শক্তি যোগায় না। অথচ আমাদের নিকট প্রতিবেশি একটি মুসলিম দেশে কী সুন্দর ইসলাম সেখানে অহঙ্কারের জায়গা দখল করে নিয়েছে।
এর কারণটা কি সেটা নিয়ে আমাদের ভাববার সময় এসেছে। আমাদের দুর্বলতাগুলো কী? কিসের অভাব আমাদের? কেন এদেশে ইসলাম এতটা অসহায় অবস্থায় এসে পৌঁছলো। আমাদের ত্রুটিগুলো কি কি? তাদের বিজয়ে আমরা আনন্দিত বটে।কিন্তু এই ক্ষণে এসে আমাদের বিষয়টাও একটু হিসাব করা দরকার। কী নেই আমাদের! সবই আছে আমাদের মধ্যে। যোগ্য লোক আছে, জনবল আছে। প্রচুর আলেম-উলামা, জ্ঞানী-গুণী, ইসলামী দল, ব্যক্তিত্ব আছে। তাহলে নেই টা কি? আসুন, সেটাই একটু খতিয়ে দেখি।
২০০১সালে কাবুল সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত তৎকালীন আমীরুল মুমেনীন সকল দলীয় নেতৃত্ব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। আমৃত্যু এই অবস্থায় ছিল। এমন কি মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত প্রকাশ হতে সময় লাগে দু’বছর। আজ পর্যন্ত কি কেউ শুনেছেন ছাত্ররা নেতৃত্ব নিয়ে কোথাও প্রশ্ন তুলেছে? অথবা তাদের মধ্যে কোন প্রকার গ্রুপিং হয়েছে? তারা প্রায় ২০টি বছর ক্ষমতার বাইরেই শুধু নয়, নানামুখি চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের দিন। অথচ তাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে কামড়া-কামড়ি, গ্রুপিং, দল থেকে বের হয়ে যাওয়া এমন কিছুর কথাই শুনিনি। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি? শুধু দল ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। কোন দল না দাঁড়াবার আগেই নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা সংঘাত, নানা বিভক্তি। গত বিশ বছরে মাত্র ৩জন আমীর। তাও একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পর একজন আমীর নির্বাচিত হন। তিনি বোমায় শহীদ হলে বর্তমান আমীর হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাহ আমীর হন ২০১৬সালে। সেই থেকে এখনো আছেন। শুধূ আছেন তাই নয়, এতবড় বিজয়ের পরও তিনি আত্মগোপনে। লোকচক্ষুর আড়ালে। কোন প্রকার নিজেকে শোডাউন করার ইচ্ছা উনাদের কারো মধ্যে নেই। এটা কি এত সহজ বিষয়? এখানেই আমাদের প্রচন্ড রকম দুর্বলতা। আমরা নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল আনুগত্য করতে পারিনি।
একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, আ ফ গা নে এতবড় একটি বিজয় আসলো, সেখানে শুধু হুজুররা। কাতার থেকে শুরু করে কাবুল সব জায়গাতেই হুজুরদের একচ্ছত্র দাপট। অথচ একজনকেও হুইল চেয়ারে দেখলাম না। উনাদের মধ্যে কি বয়স্কদের মুল্যায়ন করা হয় না? নাকি তরুনরা এতটাই বেআদব যে, তারা মুরুব্বিদের মানতে চায় না? তারা সকল ক্ষেত্রে সক্ষম নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। মোল্লা ওমরের ৩০বয়সি ছেলে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের জন্য একেবারে বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্যদের মানা হয় না। আর শেষ বয়সে মুরুব্বিগণ হয়ে পড়েন সম্পুর্ণরূপে খাদেম নির্ভর। আর বাংলাদেশে দল ভাঙ্গা-গড়ার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ যে, শেষ বয়সে কোনটা মুরুব্বির সিদ্ধান্ত আর কোনটা খাদেম-খুদ্দামের সিদ্ধান্ত সেটা পার্থক্য করা যায় না।
এতবড় বিপ্লব যারা বিশ্বকে উপহার দিলো, তাদের নামের আগে-পরে লকবের কোন বাহাদুরি নেই। শুধুই মোল্লা, অথবা মৌলভী। এর বাইরে তাদের নাম বলার সময় আর কিছুই বলা হয় না। আর আমাদের দেশে নাম নেওয়ার আগে এক পৃষ্ঠার লকব পড়তে হয়। তারা মনে হয় আল্লামা, শায়খুল হাদীস, শাইখুত তাফসীর, খতীবে আযম, আমীরুল উমারা, সুলতানুল ওয়ায়েজীন, খতীবে মিল্লাত ইত্যাদি কোন উপাধি পাওয়ার উপযুক্ত না। যে কারণে নামের ব্যাপারে তাদের এই কৃপণতা আমাদের কষ্ট দেয়! আমাদের দেশে মোল্লা-মৌলভীদেরতো কোন খাওয়াই নেই। যে কারণে এত এত লকব লাগাতে হয়। মেশকাত, দাওরা পড়ে, বক্তা। তার নামের শুরুতেও দেশে আল্লামা ব্যবহার করা হয়। আফসোস।
ধৈর্য ও ত্যাগের উৎকৃষ্ট নমুনা :
আ ফ গা ন ছাত্র নেতৃত্ব যে পরিমাণ ধৈর্য ও ত্যাগের নমুনা দেখিয়েছে আমরা তা কল্পনাও করতে পারি না। পদের লোভ, চেয়ারের লোভ কোন কিছুই তাদেরকে দুর্বল করতে পারেনি। বস্তায় বস্তায় ডলারের অফারও তারা বিনা চিন্তায় প্রত্যাখ্যান করেছে। কোন হুমকির কাছে তারা আত্মসমর্পন করেনি। আর আমাদের মধ্যে যারা একটু চালাক, তারা কতটা সহজেই অন্যের শিখানো বুলি আয়ত্ব করে নিয়েছে যা দেখেও লজ্জা হয়। যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, ভালো কিছুর আশা করতাম, তারা নির্ভাবনায় ভীতি ও প্রলোভনের কাছে হেরে গেছে। যাদের পায়ের কাছে বসে থাকাকে একসময় তারা কৃতিত্বের মনে করতো, অর্থ ও স্বার্থের কারণে সেই লোকগুলোর ফাঁসি চাইতে তারা বিলম্ব করে নাই। কলিজাফাটা দুঃখ এখানেই। যিনি যত বড় দায়িত্বে থাকবেন, বিপদ তার ততই বেশি আসবে। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তিনিও হাসতেন। আমরাও হাসতে পারতাম। কিন্তু আফসোস। আমরা হাসতে পারিনি।
সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে ক্ষমতার রজ্জু আঁকড়ে ধরতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বড় বড় মাশায়েখগণ কী এক অজানা হেকমতের জন্য যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা আর রাজ্য ভাবনা থেকে অনেকটাই নীরবে দূরে রয়েছে। এই দূরে থাকাটাকে কৃতিত্বের মনে করছে। অথচ উনারা পৃথিবীর সকল পরাশক্তিকে পরাজিত করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। আর যে কারণে কাবুল এয়ারপোর্ট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর যে চিত্রটা আমরা দেখলাম, সেখানে কিছু হুজুর নসিহত করছেন, আর বদরী ৩১৩ব্রিগেডের জানবাজ সৈনিকরা ছাত্রের মতো তাদের কথা শুনছে। বাংলাদেশে কি এটা কোনদিন কল্পনা করা যায় যে, দেশের একজন শীর্ষ আলেম নসিহত করবেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবেন, আর সেনাপ্রধান উনার কাছে হাঁটুগেড়ে বসে তার নসিহত শুনবেন। এদেশের সেনা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি তাদের কথা শুনে তাদের একজনও আলেম নন। দ্বীনি জ্ঞান সম্পন্ন নন। পার্থক্যটা এখানেই।
এদেশেও মাদ্রাসাগুলোতে চান্দাবাজির ৩১৩সদস্য আছে। মু জা হি দ কমিটি আছে। আ মী রু ল মু জা হি দী ন আছে। এর সবগুলোকেই আমার কাছে ডেমু মনে হয়। চায়না খেলনা পিস্তল, খেলনা গাড়ীর মতো মনে হয়। এসব বরকতি নাম আমরাও ব্যবহার করি। কিন্তু এগুলো আসলে প্রকৃত যে অর্থ বহন করে সেটা বুঝায় না। এদেশেও খুরুজ ফি সাবিলিল্লাহ আছে, ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ আছে। এগুলোর অর্থ আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। এর যে আরো রূঢ় বাস্তব অর্থ আছে, সেগুলো আমরাই জনগণকে ভুলিয়ে দিয়েছি। ফলে খেলনা পি স্ত ল দিয়ে যেমন তেমন কিছুই অর্জন করা যায় না, তেমনি এসব বরকতি নাম দিয়েও কিছু হয় না। এ যুগে এর প্রকৃত অর্থ কী হতে পারে সেটা আ ফ গা নে র ছাত্র নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা প্রতিটি শব্দের প্রকৃত অর্থে প্রয়োগ করে দেখাচ্ছে। হয়তো আমরাও কোনদিন খেলনা ফেলে দিয়ে বাস্তবে ফিরো যাবো। কিন্তু সেটা কতদিনে কেউ জানে না।
দুনিয়া এখন অনেক পরিবর্তনশীল। চাইলেই একা একি অনেক কিছু করা যায় না। যে বাস্তবতার কাছে ছাত্র নেতৃত্ব অনেক কিছু শিখেছে। তারা নিজেদেরকে অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বদলে নিয়েছে। চিন্তা-চেতনায় পরিপক্ষতা এসেছে। গোটা বিশ্বকে তারা কূটনৈতিক ভাষায় যোগ্যতার সাথে সবকিছু ঢিল করছে। এক্ষেত্রেও আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের মধ্যে চিন্তার পশ্চাতগামিতা অনেক বেশি। অবাস্তবতা অনেক বেশি। কোথা থেকে আমাদের শুরু করতে হবে, আমাদের বাস্তব ক্ষমতা কতটুকু, আমাদের আসলে কী করতে হবে এ সম্পর্কে পরিস্কার কোন ধারণা উপর স্তরেও নেই।
কওমী সনদের স্বীকৃতির মতো একটি স্বাভাবিক বিষয়েও আমাদের ঢিল করা কৌশলগুলো পরিপক্ষ ছিল না। অসম্পুর্ণ স্বীকৃতি আদায়, গণভবনে গমন, শোকরানা মাহফিল সব মিলিয়ে আমরা সরকারের ফাদেঁর বাইরে কোনভাবেই যেতে পারিনি। আমরা আমাদের স্বার্থ যথাযথভাবে আদায় না করেই অনেক কিছু পাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছি। অথচ বাস্তবে তেমন কিছুই পাইনি। এর জন্য সরকার নয়, আমরাই দায়ী। অথচ ছাত্র নেতৃত্ব কী চায়না, কী রাশিয়া, কী ইরান, আমেরিকা, ভারত, তুরস্ক সবার সাথেই যথাযথ যোগ্যতা ও দাবীর পরিচ্ছন্নতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তুরস্ককে ন্যাটো বাহিনীর সাথে বিদায় করেই ছেড়েছে। আবার তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের নতুন চুক্তি করতে ডেকে এনেছে। এটা চাট্টিখানি কথা নয়। দাবীও আদায় হয়েছে। আবার সম্পর্কও নষ্ট হয়নি। একেবারেই দক্ষতার গেইম। আমরা পারিনি। কোনক্ষেত্রেই পারিনি।
আজ এ পর্যন্তই। আরো অনেক কিছু বলার ছিল। লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই বলা সম্ভব হয়নি। হয়তো আপনি আমার থেকেও আরো অনেক ভালো পয়েন্ট বের করতে পারবেন, আমরা যে কারণে বারবার হেরে যাই, ওরা কেন বারবার হারে না। আল্লাহ তায়ালা বাঙ্গালী মুসলমানদের যোগ্যতা ও সময়জ্ঞান দান করুন।
জেনারেল সেক্রেটারী
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট বিআইএম
05.09.2021