বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মপ্রাণ। এটা সর্বজন বিদিত। যে কারণে এদেশে ধর্মের নামে যে কোনো কিছুই দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটা অনেকক্ষেত্রে ভুল পথে হলেও। আর এ কারণেই হিযবুত তাওহীদ এর এমামদের মতো প্রকাশ্য ভন্ডরাও মার্কেট পায়। তাদের বিপুল অনুসারী মিলে যায়। তো কেউ যদি হকের পথে চলে, তাদের অনুসারী বাড়বে এতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকার কথা নয়। বাস্তবেও দেখা গেছে ইসলামের জন্য নিবেদিত তরুনের অভাব এদেশে নেই।
এদেশে বিপুল সম্ভাবনাময় ইসলামপ্রেমিক একদল তরুন সম্প্রদায় যারা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে সঠিকপথে কাজে লাগানোর মতো প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক অবকাটামো গড়ে উঠেনি। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো এদেরকে পশ্চিমা হাওয়ায় ভয়ের দৃষ্টিতে দেখে। আর ইসলামী দলগুলোও এদেরকে যথাযথ মূল্যায়ণ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে অনেক তরুন জীবনের শুরুতে প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে নানা ব্যানারে কাজ করলেও এক সময়ে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। দলের শীর্ষনেতাদের অযোগ্যতা, তাদের সীমাবদ্ধতা, তাদের গোষ্ঠীবদ্ধ চিন্তা, মেধার বিকাশ ঘটাতে কর্মসূচীর অপর্যাপ্ততা, সৃজনশীল চিন্তার অভাব, কর্মসংস্থানের সংকট ইত্যাদি কারণে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। নানা দিকে তারা ছড়িয়ে পড়ে। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা ক্ষোভ, ভবিষ্যত জীবন নিয়ে নানা শঙ্কা তাদেরকে বাধ্য করে দল ত্যাগ করতে। অথবা নিস্ক্রীয় হয়ে যেতে।
বর্তমানে দেশে দুটি ইসলামী দলে ব্যাপক কর্মী সমবেত হয়েছে। তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। রাতদিন পরিশ্রম করে। জীবনকে রাজপথে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, মধ্যম সারির নেতৃত্বে যে পরিমাণ যোগ্য নেতৃত্ব থাকে, বা আছে, র্শীর্ষ পর্যায়ে সেই পরিমাণে এমন উদার ও যোগ্য নেতৃত্ব নেই যারা এই বিপুল সংখ্যাকে কাজে লাগাতে পারে। রাজনীতিতে বড় ধরনের সিন্ডিগেট কাজ করে। এরা যোগ্যদের উপরে উঠার পথ বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনাময় দলে দু ধরনের সংকট।
তুলনামূলক ইসলামী ধারার বেশি কর্মী রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে। উভয় দলেই যথেষ্ট কর্মী রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীতে যথেষ্ট যোগ্য ও বড় সংখ্যার জনবল রয়েছে। ৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০১ ০ ২০০৮ এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহন করে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তাদের ছাত্র সংগঠনে যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র রয়েছে। কিন্তু তাদের এই রাজনৈতিক উত্থানকে ঠেকিয়ে রেখেছে এদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি এবং মূলধারার ধর্মীয় দলগুলো। তাদের অভ্যন্তরীণ দর্শনগত ভুলও রয়েছে এই সমস্যার অন্তরালে বড় ধরনের বাধা হয়ে। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে অনেক সাধারণ কর্মী রয়েছে। পাশাপাশি তাদের ছাত্র সংগঠন ও যুব সংগঠনের সাথে চলমান আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে বিপুল সংখ্যক নতুন কর্মী সংযুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার নানা ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি এখনো অপর্যাপ্ত।
তারুন্যে ভাবনার উতলা হাওয়া বয়। ইসলামী ছাত্র ও যুব আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের মধ্যেও একটি বিপুল উতলা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা বড় ধরনের কোনো প্রতিকূল কোনো পরিবেশ এখনো মোকাবেলা করেনি। তাদের ওপর সরকারি স্টিমরোলার চলেনি। এ কারণে তারা নিরাপদে গত ১৩/১৪টি বছর নিরাপদে কাজ করতে পেরেছে। তাদের যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে। সারা দেশে তারা নির্বিবাদে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, যে গতিতে তাদের সংখ্যা বিস্তার লাভ করেছে সে পরিমাণে, সে গতিতে তাদের ট্রেইনড আপ করা যায়নি। এখনো তারা অনেক বাস্তবতাকে উপলব্দি করতে পারছে না। এটা তাদের নানা মন্তব্য, মনোভাব, বক্তব্যে বুঝা যায়। রাজনৈতিক বাস্তবতা বড় নির্মম। তাদেরকে এ লাইনে আরো বহুদূর যেতে হবে। সংখ্যা দিয়ে সবসময় অনেক কিছু হয় না। এ সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত লোকের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনাময় তারুন্য গত ১৩/১৪ বছরে নানা কারণে জামায়াতমুখি হয়েছে কম। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন মুখিই হয়েছে বেশি। এর বাইরে যতগুলো ইসলামী দল ছিল তারা রাজনৈতিক ঝড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। এদের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। যদিও তারা ব্যানার ধরে রেখেছে। কিন্তু এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই বললেই চলে। এসব দলগুলোর বেশির ভাগই এখন শুধু অফিসে বসে ব্যানার প্রদর্শন সর্বস্ব প্রোগ্রাম করে। আপাতত: এদের ঘুরে দাঁড়ানো অনেক কঠিন মনে হয়।
সম্ভাবনার অপার বাংলাদেশে অতীব আশ্চর্যের বিষয় হলো, সম্ভাবনাময় দুটি ইসলামী দলের রাজনীতি চরম বিপরীতমুখি। সাধারণ নেতা-কর্মীদের এভাবেই তৈরি করা হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে দেশের স্বার্থে, দীনের স্বার্থে, উম্মাহর স্বার্থে এক হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি এই বিপরীতমুখিতাকে পরিবর্তন করে দেওয়া যেতো, তাহলে উপকার হতো দেশের, দীনের, উম্মাহর। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এদেশে রাজনীতিতে চরম বিপরীতমুখি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখনো কখনো মুখ দেখাদেখি সম্ভব হলেও সম্ভাবনাময় এ দুটি ইসলামী দলের মধ্যে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ঐক্য সুদূর পরাহত ভাবনা। এ দেশে এই ভাবনাটাও পাপ। বড় ধরনের গোনাহের কাজ।
হাজার হাজার মেধাবী তরুন দলের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেয়। কিন্তু বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না। নেতারা যথাস্থানে আজীবনের জন্য বহাল থাকে। তারা অনেক সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু কর্মীরা যতই কোরবানি করুক কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। একটি পর্যায়ে গিয়ে অভিজ্ঞ কর্মীরা হতাশ হয়। আশাহত হয়। বুকভরা বেদনা নিয়ে নিস্ক্রীয় হয়।
এভাবে আর কতকাল? তরুনরা আর কত হতাশ হবে? ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ তারুন্য এবং ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ যোগ্য ধর্মীয় নেতৃত্ব পেলে এদেশে কাঙ্খিত ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল হতে পারে। নেতৃত্বই বড় সংকট। এ সংকট কাটিয়ে উঠার আপাতত: কোনো সম্ভবানাও দেখা যাচ্ছে না। সুদিন দেখার অপেক্ষায়। বেদনাহত লাখো তরুনের প্রতি সমাবেদনা।
15.08.2022